আজকে আর অফিসের কাজে তেমন মন দিতে পারছি না। আমার বড় বোন খানিক পরপর ফোন দিচ্ছে। ফোন দেয়ার হেতুটা খুবই ক্ষুদ্র। আমার মা বাবার সাথে রাগ করে বোনের বাসায় চলে গিয়েছে। ছোটবেলা থেকেই এই ঘটনাটি অসংখ্যবার ঘটতে দেখেছি। তাই ব্যাপারটা আমি স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছি। কিন্তু আমার বোন তা করছে না। সে অস্বাভাবিকতার গন্ধ পাচ্ছে। তার ধারণা এর পেছনে আমার বউয়ের হাত আছে।
আমার বউয়ের নাম রুমা। মাস ছয়েক আগে আমাদের বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যেই শ্বশুরের সাথে সিন্ডিকেট করে শাশুড়িকে ঘরছাড়া করার মতো মেয়ে সে না। এই ছয় মাসে সে কোনদিনই আমার বাবা মা সম্পর্কে কোন অভিযোগ করেনি। এমন ভাল মেয়ে কেন এই কাজটি করবে?? আমার বোনের সন্দেহ যে অর্থহীন তা আমি সহজেই বুঝে নিলাম।
প্রায় দু'ঘন্টা হয়ে গিয়েছে। আমার বোনের সাথে আমার কথা হয়নি। এর কারণ হচ্ছে আমি তার ফোন ধরছি না। এই কারণেই হয়তো এইবার মা ফোন দিলো। মায়ের ফোন না ধরে বসে থাকা যায় না। তাই ধরলাম,
- হ্যালো মা...
-- কিরে, তুই তোর বোনের ফোন কেন ধরলি না এতক্ষণ??
- ব্যস্ত ছিলাম মা...
-- তাহলে আমার ফোন কিভাবে ধরলি??
- এখন ব্যস্ত না। কি বলবে বলো??
-- তুই কেমন ছেলে? আমার এই অবস্থা জানার পরেও তুই এখনো অফিসে বসে আছিস?? তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে চলে আয়।
- মা, আমি ব্যাংকে চাকুরী করি। যখন তখন ছুটি নেয়া যায় না।
-- তুই আমাকে নিয়ম শেখাতে এসেছিস?? আমি তোকে জন্ম দিয়েছি আর তুই আমাকে নিয়ম শেখাবি?? তোর বোনের কথাই ঠিক। সব দোষ আসলে রুমার। রুমা তোকে জাদু করেছে। আজকে সে আমাকে ঘর থেকে বের করে দিলো। কাল তোর বাবাকেও বের করে দিবে। তখন তুই বউকে নিয়ে থাকিস। বাবা মার দরকার নেই তোর...
আমি ফোন কেটে মোবাইল বন্ধ করে দিলাম। এইসব সস্তা আবেগ আমার কাছে মূল্যহীন, আমি বাস্তববাদী মানুষ। ঝগড়া করলো বাবা মা, এখন শুধুশুধু মাঝখান থেকে রুমাকে টানাটানি করা হচ্ছে। মূল ঝামেলা হয় আমার বোনের কারণে। সে আমার বাসার কাছেই থাকে। তাই কিছু ঘটলেই মা তার বাসায় গিয়ে ক্যাম্প বানায়, অসহ্যকর ব্যাপার।
বাবার মুখোমুখি বসে আছি। মায়ের অনুপস্থিতিতে তাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে না। সে হাসিমুখেই দেশের সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে বক্তৃতা ঝেড়ে যাচ্ছে। আমিই মায়ের প্রসঙ্গ টেনে আনলাম। বললাম,
- মায়ের ব্যাপারটা কি?? বোনের বাসায় চলে গেল কেন??
বাবা যা বললেন তার সারমর্ম হচ্ছে, আজ রুমার জন্মদিন ছিল। তাই মা রুমার পছন্দমত দুটি তরকারি রান্না করেছিলেন। বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছ ও বড় বড় চিংড়ী মাছ ভুনা। বাবা যার কোনটিই খান না। বেগুন খেলে তার এলার্জি হয় আর চিংড়ী খাওয়া নাকি মাকরুহ, এইজন্য তিনি খান না। তরকারীর এই অবস্থা বলে বাবা মাকে বলল, "আমাকে ডিম ভেজে দাও। আমি ডিম দিয়ে ভাত খাবো।"
এই কথা শুনে মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলেন, "তুমি কোন এলাকার জমিদার যে তোমার জন্য বারবার রান্নাঘরে যাবো?"
তখন বাবা রাগ সামলাতে না পেরে বলেন, "তুইও কোন জমিদারের মেয়ে না। তোর বাপ ছিল পিয়ন। তুই পিয়নের মেয়ে। দুইবার রান্না করলে তুই মরবি না।"
তুইয়ের মাত্রা অতিরিক্ত হয়ে যাওয়ায় মা রাগ করে বোনের বাসায় চলে যায়। এখানে রুমার ভূমিকা কি তা আমি ভেবে পেলাম না। তাই বাবাকে বললাম,
- মা বলছিলো, সব দোষ নাকি রুমার। তার দোষ কি এখানে সেটাই তো বুঝলাম না!
বাবা যেই উত্তর দিলেন তা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম।
তিনি বলেন, "সব দোষ তো তোর বউয়েরই। তার পছন্দের জিনিশ রাঁধতে গিয়েই তো আজ এই অবস্থা। এত আহ্লাদী না করলে আজকে এমন ঝগড়াও হতো না, সবাই সুখেই থাকতাম।"
কথাগুলো হজম করতে আমার সময় লাগলো। একটু সময় নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম,
- তা না হয় বুঝলাম। রুমার জন্য ঝামেলা লেগেছে। কিন্তু সে আম্মাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে তা কতটুকু যৌক্তিক??
-- অবশ্যই যৌক্তিক। আর সে এটা ইচ্ছে করেই করেছে। তরকারী নিয়ে ঝামেলা করার জন্যই ইচ্ছে করে এগুলোর নাম বলেছে যেগুলো আমি খাই না। তারপর আমাকে দিয়ে তোর মাকে ঘরছাড়া করিয়েছে। ভবিষ্যতে তোকে দিয়ে আমাকে ঘরছাড়া করাবে। এই মেয়ে বিষাক্ত। আমাদের সুখ নষ্ট করলো।
আমার মন খারাপ ছিল। এইবার মেজাজটাও খারাপ হয়ে গেল। কিন্ত মন আর মেজাজ দুটিই ভাল হয়ে গেল রুমার মুখোমুখি হয়ে। বাংলার ঘরে ঘরে এমন একজন বউ থাকা দরকার যার মুখের দিকে তাকালেই মন আর মেজাজ দুটিই ভাল হয়ে যাবে। রুমা আমার কাপড় ভাজ করে ড্রয়ারে রাখছিলো। আমাকে দেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। এই মেয়েকে কখনো আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে দেখিনি। আর এই মেয়েই নাকি রাজনীতি করে আমার মাকে ঘরছাড়া করেছে। এই কথা বিশ্বাস করি কি করে!?
আমি বিছানায় বসলাম। রুমা এখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যেনো হুকুমের অপেক্ষায় আছে, হুকুম করলেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
- কেমন আছো?
-- জ্বী ভাল।
- এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?? বসো।
রুমা বসলো। বলাই বাহুল্য যে, আমার কাছ থেকে অনেক দূরে বসলো। খাটের অন্য প্রান্তে। ভেবেছে আজকের ঘটনায় তাকে আমি বকা দিবো। আমি আবার বললাম,
- আজকে তোমার জন্মদিন। আমি জানতাম না। জানলে কিছু উপহার আর কেক নিয়ে আসতাম।
-- সেগুলোর প্রয়োজন নেই।
- প্রয়োজন নেই কেন??
-- আমার জন্মদিন কখনো পালন করা হয়নি।
আমি প্রচণ্ড অবাক হলাম। বললাম,
- তোমার বাবা মা কখনো পালন করেনি??
-- জ্বী না।
- ও আচ্ছা। তারা পালন না করলেও আমি করবো। আজকেরটা কালকে করবো। কোন সমস্যা আছে?
-- জ্বী না।
- আজকে জন্মদিনে ভাল একটা ঝামেলা হলো। এই ব্যাপারে তোমার কিছু বলার আছে??
-- জ্বী না।
- আমার বাবা মা তোমাকে দায়ী করছে। তবুও তুমি নিজের পক্ষ নিয়ে কিছু বলবে না??
-- জ্বী না।
- কেন??
-- নিজের পক্ষ নিয়ে কিছু তখনই বলতে হয় যখন সে অপরাধ করে। আমি আজকে কোন অপরাধ করিনি।
আমি কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না। আসলেই তো, রুমার কথাই ঠিক। ঝগড়া করেছে বাবা মা। এখন দোষ দিচ্ছে রুমার। এখানে তার কি বলার থাকবে?? সে কেন জবাবদিহি করবে?? রুমার স্পষ্ট কথা শুনে ভাল লাগলো। আমি বললাম, "আচ্ছা ঠিক আছে। এইসব কথা বাদ দাও। এখন যাও, খাবারের ব্যবস্থা করো।"
রুমা প্রায় দৌড়ে চলে গেল। আমি আশ্চর্য হলাম। এই মেয়ে আমাকে এত ভয় পায় কেন?? কোনদিন তাকে আমি ধমকও দেইনি। এই কথা ভেবেই মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল।
রুমার সাথে আমার বিয়ে হয় আমার ঘটকের সূত্রে। অবশ্য আমার বাবা এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না। কারণ রুমার জন্মের সময় তার মা মারা যায়। সে বড় হয়েছে সৎ মায়ের কাছে। পড়াশোনা করেছে মাত্র মেট্রিক পর্যন্ত। মেট্রিকে গোল্ডেন এ+ পাওয়ার পরেও সে আর পড়াশোনা করেনি। এমন না যে, তার বাবার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই। তাহলে কেন সে আর পড়লো না! ব্যাপারটা রহস্যজনক।
যেই মেয়ে মাত্র মেট্রিক পাস তাকে বিয়ে করার ইচ্ছে আমার ছিল না। কিন্তু ঘটকের চাপাচাপিতে আমি মেয়ে দেখতে রাজি হয়ে গেলাম। কারণ সে বলল, মেয়েকে সরাসরি দেখলেই নাকি আমি বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবো।
ঘটকের কাজ হচ্ছে চাপাবাজি করা। আমি ভেবেছিলাম রুমার ব্যাপারেও সে চাপাবাজি করছে। কিন্তু যখন রুমাকে প্রথম দেখলাম তখন বুঝেছিলাম, ঘটক কিছুই বাড়িয়ে বলেনি। আমার মনে হয় সে কমই বলেছিলো। রুমার সাথে কথা বলার জন্য আমাকে একা ঘরে পাঠিয়েছিলো। আমি তার সাথে কথা বলবো কি! পুরো সময়টা তার দিকে তাকিয়ে থেকেই কাটিয়ে দিলাম। ঘটনাটি হাস্যকর। তবুও আমি এই কান্ড ঘটিয়েছিলাম। কারণ রুমার মতো সুন্দরী মেয়ে আমি আমার সারাজীবনেও দেখিনি। শেষদিকে রুমা কেঁদে দিয়েছিলো। সে কিছু বলতেও পারছিলো না আবার চলে যেতেও পারছিলো না। সেদিন ওকে কাঁদাতেও ভাল লাগছিলো।
বাবা না চাইলেও আমার আগ্রহেই বিয়েটা হয়। মেয়েকে দেখে তার মেট্রিক পর্যন্ত পড়ালেখা, সৎ মায়ের কাছে বড় হওয়া এইসব ব্যাপার ঘড়কুটোর ন্যায় ভেসে গেল। আমার তখন দুনিয়া একদিকে আর আরেকদিকে হচ্ছে, রুমা।
রুমাকে আমি অসম্ভব ভালবেসে ফেলেছি গত ছ'মাসের বৈবাহিক জীবনে। তাই সাম্প্রতিক এই ঘটনায় আমার প্রচণ্ড রাগ হলো। বাবা মা ও বোনকে প্রচণ্ড অপরাধী মনে হতে লাগলো। অসহ্য বোধ হতে লাগলো তাদের প্রতি। আমি অফিসে দরখাস্ত দিয়ে ঢাকা থেকে ট্রান্সফার হয়ে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিতে আমার বেশি সময় লাগেনা আর আমি কখনো সিদ্ধান্তহীনতায়
বাসায় ফিরলাম কোন উপহার আর কেক ছাড়াই। রুমার জন্মদিন আজ পালন করার কথা বলেছিলাম। কিন্তু মনে ছিল না। বাসায় এসে মনে পড়লো। রুমা অবশ্য আমার হাত খালি দেখেও কোন প্রশ্ন করলো না। এই মেয়েকে কখনো বাড়তি চাহিদা বা আহ্লাদী করতে দেখিনি। আমি রুমাকে ডেকে বললাম,
- আজ তোমার জন্মদিন পালন করার কথা ছিল। মনে আছে??
-- জ্বী।
- কেক তো আনতে ভুলে গেছি। কিন্তু উপহার সাথে এনেছি। তোমার জন্য উপহার হচ্ছে, আমার ঢাকা থেকে ট্রান্সফার হয়েছে। সেখানে চলে যাচ্ছি। তুমি সাথে যাবে আর বাবা মা এখানে থাকবে।
রুমা মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখ ফিরিয়ে নিলো না। সে অবাক হয়েছে, যথেষ্ট অবাক হয়েছে। তার এত অবাক হওয়াতে আমি বিস্মিত হলাম। তার তো খুশি হওয়ার কথা, তাকে আর কেউ মিথ্যা অপবাদ দিতে পারবে না। কেউ দোষারোপ করবে না। তাহলে সে কেন অবাক হচ্ছে?!
মা টানা ১০ দিন বাড়িতে ফিরলো না। বাবার কোন তাগিদ দেখলাম না মাকে ফেরানোর। তবে আমার ঢাকা ত্যাগের খবরে মা বোন দুজনই বাড়ি ফিরে এলো। মা শুরু করলো মরাকান্না। এইসব আবেগের আমি কোন দাম দেই না। ঝগড়া করে একটি নিরীহ মেয়েকে ফাঁসানোর সময় আবেগ কই ছিলো?? এখন ছেলেকে হারালে বুঝবে। মাঝেমধ্যে এমন টাইট দেয়া ভাল, নইলে নিজেকে রাজা বাদশা আর অন্যদের প্রজা মনে করবে।
ঢাকা থেকে চলে এসেছি প্রায় ৩ দিন হলো। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে প্রথম দিন থেকেই আমার প্রচণ্ড মাথাব্যথা। এই সমস্যা আমার কোনকালেই ছিল না। কিন্তু এখন কেন হচ্ছে বুঝতে পারছি না। অফিস থেকে ফিরে কাপড় পরিবর্তন না করে শুয়ে পড়লাম। মাথাব্যথা আর সহ্য হচ্ছে না। রুমা পাশে এসে বসলো। তাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। আমার এমন অবস্থা সে আগে কখনো দেখেনি। রুমা বলল,
- আপনার কি শরীর খারাপ??
-- হু। মাথাব্যথা।
- মাথা মালিশ করে দিবো??
আগে কোনদিন রুমা এমন করে বলেনি। তাই আমি বললাম, দাও। রুমা মাথা আর কপাল মালিশ করে দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে চুলও টেনে দিতে লাগলো। ভালই লাগছিলো। হঠাৎ রুমা বলল,
- একটা কথা ছিল। যদি রাগ না করেন তাহলে বলবো??
-- রাগ করবো না। বলো...
- আপনি ইচ্ছে করে ঢাকা থেকে ট্রান্সফার হয়েছেন। ঠিক না??
চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম। চোখ খুলে রুমার দিকে তাকালাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে নেই কোন লজ্জা, নেই কোন ভয়! চোখ ভারি ভারি। মনে হচ্ছে এখনই কেঁদে ফেলবে। আমি অবাক হয়ে গেলাম ওর এই অবস্থা দেখে। বললাম,
- হ্যাঁ। নিজের ইচ্ছাতেই হয়েছি।
-- কেন??
আমি কি তাকে সঠিক কথাটিই বলবো? নাকি বানিয়ে বানিয়ে অন্য কিছু বলবো! তাকে আমি একটি বোকা ও লজ্জাশীল মেয়ে বলে জানতাম। কিন্তু আমার ধারণা ভুল। রুমা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। আমার ধারণা সে জানে আমি কেন ঢাকা থেকে চলে এসেছি। তাই বললাম,
- আমার মনে হয় তুমি কারণটা জানো??
-- জ্বী জানি। আপনি আর বাবা মার সাথে থাকতে চাইছেন না।
- তাতে কি আমার অপরাধ হয়েছে??
-- জ্বী। আপনি অপরাধ করেছেন।
আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম। রুমা মাথা নিচু করে বসে আছে। কথাটা বলেই ও মাথা নিচু করে ফেলেছে। আমার মেজাজ গেল চড়ে। আমি যার জন্যে এতকিছু করেছি সে নাকি বলে আমি অপরাধ করেছি। আমি বললাম, "মাথা নিচু করে আছো কেন?? তাকাও আমার দিকে??"
রুমা আমার দিকে তাকালো। তার চোখ ভেজা। এতক্ষণ নিরবে কাদঁছিলো। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। সে কেন কাঁদবে?? আমি আবার বললাম,
- আমার কেন অপরাধ হবে?? ব্যাখ্যা করো?
-- বাবা মাকে একা ফেলে রেখে বউকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া অপরাধ।
- তারা কি করেছিলো তা তুমি ভুলে গিয়েছো?? তোমাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিলো।
-- আমি কি কোন অভিযোগ করেছিলাম??
- তুমি অভিযোগ না করলেও এটি সত্য।
-- না সত্য না। বাবা মায়ের অপরাধ কোন অপরাধ না।
- কেন?? তারা জন্ম দিয়েছে বলে??
-- জ্বী।
- জন্ম দিবে বলে যা খুশি তা করবে??
-- জ্বী করবে। তারা চাইলে আপনাকে পৃথিবীতে না আনতে পারতো।
- এনেছে স্বার্থের জন্য। আমি না এলে বৃদ্ধ বয়সে তাদের খাওয়াবে কে!?
-- আপনার ব্যাখ্যা ভুল।
- আমি যদি বলি তোমার ব্যাখ্যা ভুল।
-- তা বলতে পারেন। কিন্তু আপনি আমার সাথে একমত হতেন যদি আপনার আমার মতো মা না থাকতো।
আমি চুপ মেরে গেলাম। এই মেয়ে বলে কি! যেই মেয়ে এতদিন জ্বী জ্বী বলে গিয়েছে আজ সে আমাকে জ্ঞান দিচ্ছে! রুমা আবার বলল,
- আপনার বাবা মা বুঝে ফেলেছে যে, আপনি আমাকে প্রচণ্ড রকমের ভালবাসেন। এইজন্য তারা ভাবছেন আমি আপনাকে তাদের থেকে আলাদা করে দিবো। তাই তারা আমাকে আপনার চোখে খারাপ করে দিতে চাইছে। তাদের দোষ নেই, আমি তাদের জায়গায় হলে আমিও এই কাজটিই করতাম।
-- তুমি এইটাও জানো যে আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি??
- জ্বী জানি। টের পাওয়া যায়। কারণ আমাকে কেউ কোনদিন ভালবাসেনি!
আমি এবার তব্দা খেয়ে গেলাম। এই মেয়ে বলে কি! আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই মেয়ে সুস্থ না। সে নেশাগ্রস্থ মানুষের মতো বলতে লাগলো,
- আপনি জানেন না, আমি কেন মেট্রিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। এর কারণ হচ্ছে, আমার সৎ মা। তিনি আমার ভাল ফলাফল সহ্য করতে পারেননি। তাই আমাকে আর পড়াননি। আপনি আমার পিঠের কাল দাগ দেখে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলেন মনে আছে?? আমি বলেছিলাম এটি আমার জন্মদাগ। আসলে কথাটি মিথ্যা। আমার সৎ মা আমাকে গরম চামচ দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলো। আমার অপরাধ ছিল কি জানেন?? আমার সৎ বোনকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসে আমাকে পছন্দ করেছিলো। বলে দিয়েছিলো এরপরে আবার পাত্রপক্ষের সামনে গেলে আমার কপাল পুড়িয়ে দিবে।
আমি ছোটকালে কখনো মায়ের দুধ খেতে পাইনি। জন্মের সময়েই মা মারা যান। গরুর দুধ খেয়ে বড় হয়েছি। আমার সৎ মা সারাজীবনে আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আপনার মাকে আমি নিজের মায়ের মতো ভেবেছিলাম। আপনার মা অনেক ভাল ছিল। অন্তত অপরাধ ছাড়াই পিঠ জ্বালিয়ে দেয়া বা চড় থাপ্পড় তো দিতো না।
আমি একদম স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। এমন হৃদয়বিদারক কথা আমি কোনদিন কারো মুখে শুনিনি। রুমার কাছ থেকে এগুলো শুনতে হবে তা কোনদিন কল্পনাও করিনি। রুমা এখনো কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, "আপনার তো অন্তত একজন মা আছে। আমার তাও ছিল না। সে থাকলে আমার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূর্ণ হতো। চড় থাপ্পড় আর স্যাক খেয়ে বড় হতে হতো না।"
আমি বারান্দায় চুপচাপ বসে আছি। ভাবছি মায়ের কথা, বাবার কথা।
অফিসে যাওয়ার আগে মনে পড়তো শু জোড়া ময়লা হয়ে গিয়েছিলো। সাফ করতে হবে। শু হাতে নিয়ে দেখতাম শু চকচকে করছে। মাকে জিজ্ঞাসা করলে মা বলতো, তোর বাবা পরিষ্কার করে দিয়েছে।
একবার দু'বার করেছে এমন না। প্রায়ই তিনি এই কাজটি করতেন আমার অলক্ষে। আমি লজ্জায় কোনদিন তাকে বারণ করতে পারিনি।
আমার মায়ের ঘামাচি সমস্যা থাকার পরেও তিনি রান্নাবান্নার দায়িত্ব রুমার হাতে দেননি। এতদিন এর কারণ না বুঝলেও আজ বুঝতে পারছি। ছেলেকে হারানোর ক্ষুদ্রতম আশংকাও তারা রাখতে দেননি।
রুমা কাঁদছে। কাঁদুক, কাঁদার দরকার আছে। ভুল অবশ্য আমার। যেই বিষয়টার সমাধান সহজ, তা আমি জটিল করে ফেলেছি। জটিল এক সমাজে বাস করতে করতে বাবা মার সাথেও জটিল হিসেব নিকেশ করে ফেলেছি। জীবনে প্রথমবারের মতো হার মানলাম আমি। রুমার মতো মেয়ের কাছে হার মানতে লজ্জা কিসের!
মেয়েটি এখনো কাঁদছে। তার কান্না থামাতে এগিয়ে গেলাম। আমি ছাড়া তার কান্না থামানোর মতো কেউ আর এই জগতে নেই। কথা দিলাম, "আর কোনদিন কাঁদতে দেবো না, রুমা।"
|| সমাপ্ত ||
0 Response to "গল্প - রুমা। আজকে আর অফিসের কাজে তেমন মন দিতে পারছি না।"
Post a Comment