![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgzxNezIrd3jKNYPFf4jYj_cUy-21lBJl94uQJ94QHUM6voVNerGcr8IOatXQPxjdM9R4WNhN-vskdd1kILek0uvkR1VUo9MSNRz4dMg3xvDWWy63-JT83NarJvvpboi1vfHEquPNddxwiv/s1600/%25E0%25A6%25A8%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%259C.jpg)
শ্রাবণী চেয়ারে বসে টেবিলে খাতা রেখে কী যেনো লিখছিলো। মিসেস শারমিন সুলতানা ওযু করে বের হয়ে দেখলেন আজান হচ্ছে অথচ শ্রাবণীর মাথায় তো দূর গায়ে পর্যন্ত উড়না নেই। মিসেস শারমিন নরম স্বরে বললো, "আজান হচ্ছে তা কি তুমি শুনতে পেয়েছো?"
মার কথা শুনে শ্রাবণী বিছানার উপর থেকে উড়না নিয়ে মাথায় ঘোমটা দিলো। যদিও ততক্ষণে আজান শেষ হয়ে গেছে। মিসেস শারমিন মেয়েকে বললেন, "যাও ওজু করে এসো। নামাজ পড়ো"
শ্রাবণী খাতার উপর থেকে মুখ না তুলেই বললো, "তুমি পড়ো তো মা। আমি পরে পড়বো নে। এখন আমার অনেক পড়া আছে। যাও বিরক্ত করো না"
তিনি আর কিছু না বলে নিজের কক্ষে চলে যান। মেয়েটা তার কথা একদমই শুনতে চায় না। এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ে তো তিন ওয়াক্ত পড়ে না। বারবার বলতে বলতে তিনি হতাশ। একমাত্র মেয়ে তাই বকাঝকাও করতে পারেন না। মেয়ে আবার বাবার খুব আদুরে। বাবাকে যা বলে তিনি তা এক কথায় মেনে নেন। তাই মিসেস শারমিন ভাবে যদি মেয়েটাকে নামাজি করে তুলতে পারে তাহলে স্বামীকেও হয়তো পারবে। মেয়ে বললেই তিনি মেনে নিবেন। মিসেস শারমিন স্বামীকে যথেষ্ট ভয় পায়। স্বামীকে বেশ কয়েকবার বলেও কোনো লাভ হয়নি। বরং মজা করে এড়িয়ে গেছেন। বলেছেন, "তুমি তো পড়তিছো। তোমার লেজ ধরে আমিও বেহেস্তে চলে যাবো নে। হাহা" এখন মেয়েই একমাত্র আশা।
মিসেস শারমিন নামাজ শেষ করে এসে দেখলেন শ্রাবণী এখনো লেখায় ব্যস্ত। তিনি বিছানায় বসে বললেন, "তোর কি খুব বেশি পড়া আছে?" শ্রাবণী ইতস্তত করে বললো, "না মা। কিন্তু এখন নামাজ পড়বো না। প্লিইইজ। ভালো লাগছে না"
মিসেস শারমিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, "আচ্ছা ঠিক আছে। আমার কাছে আয় দেখি। কোলে মাথা রেখে চুপটি করে শুয়ে থাক। তোকে আমার ছোটবেলার গল্প শোনাই"
শ্রাবণী এসে মায়ের কোলে মাথা রেখে শোয়। তার মা চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, "আমি, তনয়া আর জুঁই ছিলাম খুব ভালো বান্ধবী। তিনজন তিনজনের কথা শেয়ার না করলে যেনো পেটের ভাত হজম হতোই না। এমন কোনো দুষ্টুমি ছিলো না যেটা আমরা করতাম না। ছেলেদের পর্যন্ত পিটিয়েছি। একদিন সকালবেলা ক্লাসে গিয়ে দেখি তনয়ার ব্যাগ আছে অথচ তনয়া নেই। জুঁই ও চলে এসেছে। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, "তনু কই রে?"
আমি জবাব দিলাম, "জানি না। আমিও মাত্র এসে দেখি ও নাই। আমরা না আসা অবধি তো ও ক্লাস থেকে বের হয় না। আজ কী হলো?" জুঁই কপাল কুঁচকে বললো, "কী জানি! চল তো বটতলায় গিয়ে দেখি আছে নাকি?"
আমি আর জুঁই বটতলায় গিয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি তনয়া ঐ জায়গাতেই ছিলো। ও কাঁদছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, "কী হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেনো?"
জুঁই কিছু না বলে আমার পেট জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। আমি আর জুঁই একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। জুঁই এসে ওর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, "কী হয়েছে তোর? বল আমাদের"
তনয়া চোখ মুছে নাক টেনে বললো, "কাল রাতে খুব একটা খারাপ স্বপ্ন দেখছি রে। দেখি আম্মু মারা গেছে। কবরে তার অনেক কষ্ট হচ্ছে রে" আমি আর জুঁই দুইজনই স্তব্ধ হয়ে গেলাম শুনে। আমি বললাম, "ধুর! দুঃস্বপ্ন নিয়ে মন খারাপ করিস না। বরং নামাজ পড়া শুরু কর। আমরা নামাজ পড়ি না যে তাই এইসব দুঃস্বপ্ন দেখি"
জুঁই গলা নামিয়ে আস্তে করে বললো, "ঠিকই বলেছিস রে। আমাদের নামাজ পড়া উচিত। কাল থেকেই আমরা সবাই নামাজ পড়াও শুরু করবো আর পর্দা করাও। ঠিক আছে?"
আমি বললাম, "ঠিক আছে"
তারপর তনয়ার দিকে জুঁই তাকিয়ে বললো, "এইবার তো একটু হাস। তোর কান্না দেখে তো আমারই কান্না পাচ্ছে"
তনয়া হেসে জুঁইকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর আমরা ক্লাসে গিয়ে সব ক্লাস শেষ করলাম। পুরো ক্লাস তনয়া এতো খুশি আর এতো প্রফুল্ল ছিলো যে কেউ বলবেই না মেয়েটা সকালে কেঁদে চোখের পানি নাকের পানি এক করেছে।
ক্লাস শেষে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আমরা একসঙ্গেই ফিরি। আমরা গল্প করতে করতে হাটতেছিলাম। হঠাৎ করে তনয়ার হাত থেকে রুমালটা রাস্তায় পড়ে যায়। তনয়া আমাদের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে রুমালটা তোলার জন্য নিচু হতেই কোথা থেকে একটা ট্রাক ঝড়ের বেগে এসে ওকে পিষে দিয়ে চোখের নিমিষেই দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়। আমি আর জুঁই এরকম একটা ঘটনা দেখে মূর্তি হয়ে গিয়েছিলাম যেন। ট্রাকটা এতো জোরে এসেছিলো যে আমরা এক্সিডেন্ট হওয়ার আগ মূহুর্তে ট্রাকটা দেখিওনি। তনয়ার রক্তাক্ত দেহটা ঘিরে কত মানুষের ভীড়! আমাদের ঘোর কাটতে খানিকটা সময় লেগেছিলো। ঘোর কাটার পর দৌড়ে ওর কাছে গিয়ে দেখি দেহটা ছিন্নভিন্ন। ভেতরে প্রাণ নেই। আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না এটা সত্যি সত্যি ঘটেছে।
তনয়ার দেহটা দাফন হওয়ার পর থেকে জুঁই একদম চুপ হয়ে গেলো। কোনো কথা বলতো না। কিছু খেতো না। সবসময় দরজা লাগিয়ে বসে থাকতো। তনয়ার জন্য কষ্ট তো আমারো হতো। তবুও তো সব মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু জুঁই! আন্টি আঙ্কেল এমনকি আমিও ও'কে কিছু খাওয়াতে পারিনি। দুইদিন পর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হলো। তখন স্যালাইনের মাধ্যমে খাওয়ানো হতো। ষষ্ঠ কি সপ্তম দিন আন্টি ফোন দিয়ে বললো জুঁই নাকি সুস্থ। আমাকে দেখতে চাচ্ছে। আমি তখনি ওদের বাসায় চলে গেলাম। ওকে দেখে আমার চোখে পানি চলে আসলো। না কাহিল অবস্থা দেখে না। ওকে সুন্দর লাগছিলো। অকৃত্রিম একটা সৌন্দর্য যেনো এই সৌন্দর্যের উৎস অপার্থিব। এই কয়দিন ওর এমন বিধ্বস্ত চেহারা সহ্য হতো না আমার। তাই আজ এরকম রূপ দেখে খুশিতে কান্না করে দিয়েছিলাম। ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ও হেসে আমার গালে স্পর্শ করে বললো, "পাগলী কাঁদছিস কেন? এই দেখ আমি সুস্থ হয়ে গেছি। তুই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ঠিকমতো পড়িস তো?"
আমি জবাব দিলাম, "হুম কিন্তু দু'একটা বাদ যায় রে" জুঁই কপট চোখে বললো, "আমাকে ছু'য়ে প্রমিজ কর আর এক ওয়াক্ত নামাজও বাদ দিবি না। আর কাযাও যেনো না হয় সে চেষ্টা করবি" আমি হেসে ওকে ছু'য়ে বললাম, "আচ্ছা বাবা! করলাম প্রমিজ। খুশি তো"
তখন আসরের আজান হচ্ছিলো। জুঁই বললো, হুম। এখন ওজু করে এসে আমার সামনে নামাজ পড়তো দেখি। আমি তো বিছানা থেকে উঠতে পারছি না। তোকে দেখে নয়ন জুড়াই"
আমি ওযু করে এসে ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম। জুঁইও হাসলো। নামাজ শেষ করে এসে দেখি জুঁই ঘুমিয়ে গেছে। প্রশান্তির ঘুম। ওর কপালে আদর করার উদ্দেশ্যে হাত দিতেই আমি শিউরে উঠি। এত ঠাণ্ডা! কতক্ষণ ও'কে পাগলের মতো ডাকি। ও ওঠে না। চিৎকার করে আন্টিকে ডাক দেই। আন্টি ও মা, সোনা মা আমার কতকিছু বলে ডাকে ও'কে। আঙ্কেল ডাক্তারকে ফোন দেয়। ডাক্তার হাত ধরে, চোখ দেখে যখন মুখ কালো করে বললো, "স্যরি" আমি আর দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না। সোজা ঐখানেই বসে পড়লাম। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে দুই বান্ধবীর চলে যাওয়া কতটা বেদনাদায়ক তা কাউকে বলে বুঝানো যাবে নারে।
জানিস তারপর থেকে আমি একটা নামাজও বাদ দিইনি। কী অদ্ভুত! আমরা বলেছিলাম কাল থেকে শুরু করবো। অথচ ঐ কালটা তনুর জীবনে আসলোই না। আর জুঁই এর এসেও তো না আসার মতোই। আমার ভাগ্য অনেক প্রসন্ন ছিলো রে। জানিস প্রতিটা মোনাজাতে চাই আল্লাহ্ যেনো ওদের সব শাস্তি মাফ করে দেয়। করবে না বল?"
কথা শেষ করে মিসেস শারমিন ঢুকরে কেঁদে উঠে। শ্রাবণীও নিজের চোখ মুছে বিছানা থেকে উঠে যায়। মিসেস শারমিন অশ্রুসিক্ত চোখেই জিজ্ঞাসা করে, "যাচ্ছিস কোথায়?"
শ্রাবণী হেসে বলে, "ওযু করতে। তুমিই না বলো বাচ্চাদের আল্লাহ্ অনেক ভালোবাসে। আমিতো এখন বাচ্চাই। মাত্র ফাইভেই না পড়ি! তাই আল্লাহ্ আমার কথাও শুনবে। আল্লাহকে বলে আসি আন্টিদের মাফ করে দিতে। এখন থেকে রোজ তুমি আর আমি মিলে আল্লাহকে বলবো আন্টিদের যেনো মাফ করে দেয়। তারপর সবাই একসঙ্গে স্বর্গে গিয়ে গল্প করবো। হিহি" মিসেস শারমিন চোখ মুছতে মুছতে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলে, "পাগলি মেয়ে একটা"
তারপর একটা প্রশান্তির হাসি হেসে ভাবেন, "এইবার হয়তো তার পরিবারে ভালো কিছু পরিবর্তনের সূচনা হতে চলছে"
0 Response to "হাইয়্যা আলাল ফালাহ্, হাইয়্যা আলাল ফালাহ্, কাছের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজানের সুর।"
Post a Comment