ডিভোর্স লেটারটা আজকে দিনের মধ্যেই চলে আসার কথা।


ডিভোর্স লেটারটা আজকে দিনের মধ্যেই চলে আসার কথা। আসার কথা বলতে, এসে যাবে। আমি আজ অফিসে না গিয়ে একা একা বাসায় বসে আছি এই ডিভোর্স লেটারের জন্য। ডিভোর্স লেটারটা হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটাতে সাক্ষর করে ইরার কাছে পাঠাতে হবে। সেই সাথে সব কিছু শেষ হয়ে যাবে। সমাপ্তি ঘটবে একটা সম্পর্কের। সমাপ্তি ঘটবে একটা সুখী দাম্পত্যের। বিচ্ছেদ ঘটবে ভালোবাসাপ্রবন দু'টি মানুষের। যারা বছর খানেক আগে একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। ভাবা যায়?

সম্পর্ক গুলো কেমন অদ্ভুত তাই না? কিছুদিন আগেও যেখানে ভালোবাসার ফুলঝুরি ফুটতো রাত, দিন, কিংবা সন্ধ্যায়। হাটি হাটি পা পা করে সুন্দরভাবে গড়ে উঠছিলো ছোট্ট মিষ্টি একটি সংসার। আর আজ সেই সংসারেই একজনের প্রতি আরেকজনের প্রচন্ড ঘৃণা জন্মে গেল। যে ঘৃণার পরিণতি হতে যাচ্ছে ডিভোর্সে! আশেপাশে শুধু একটা শব্দই ভেসে আসছে বার বার। দীর্ঘশ্বাসের।

ভালোবাসার বিয়ে গুলোতে কি আসলেই সুখ হয় না? বিয়ে হবার পরদিন থেকেই কি ভালোবাসা একটু একটু করে মরে যেতে শুরু করে? কই, আমরা তো এসব বাজে কথা গুলো কখনোই বিশ্বাস করিনি। এই বাজে কথা গুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সারাজীবন এক সাথে থাকার শপথ নিয়েছি। কিন্তু হঠাৎ কেন এমন হলো? কেন সব শেষ হয়ে যাচ্ছে এক নিমেষেই। আচ্ছা, এই কথা গুলো বলা কি আমার মুখে মানাচ্ছে? অথবা এসব কথা বলা কি আদৌ আমার উচিত হচ্ছে? লজ্জা কি আমার লোপ পেয়ে গেছে একেবারেই? সম্পর্কটা ভাঙতে কি শুধুমাত্র আমি একাই দায়ী নয়? দোষটা কি শুধুমাত্র আমার একার-ই নয়??

ইরা বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে আজ দশ দিন হলো। এই যাওয়াই যে তার শেষ যাওয়া হবে, সেটা কল্পনা করতে পারি নি। এই ক'টা দিন একটা বারের জন্যও ইরা আমার কল রিসিভ করে নি। কোনো মেসেজেরও রিপ্লাই দেয় নি। গতকাল রাতে হঠাৎ করেই আমার মোবাইল ফোনের রিং বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখি ইরার কল। আমি ধড়ফড় করে কল রিসিভ করতেই ইরা ওপাশ থেকে ঠান্ডা গলায় বলল, "কালকের মধ্যেই ডিভোর্স লেটার টা পাঠিয়ে দিবো। সাক্ষর করে দিও। ভালো থেকো। আর কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা কোরো না" আমি কিছু একটা বলতে নিয়ে হ্যালো হ্যালো করতেই ইরা কল কেটে দিলো। পরক্ষণেই দেখি সুইচড অফ। ঠিক যেভাবে আমিও এক রাতে সুইচড অফ করে রেখেছিলাম।

সে রাতে আমি বাসায় ফিরি নি। ইরাকে কোনোভাবে বলেছিলাম, আমি এক বন্ধুর বাসায় এসেছি। আজ রাত টা এখানেই থাকবো। তুমি একটু কষ্ট করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড় লক্ষিটি। আমি সকালেই চলে আসবো। এই কথা গুলো দ্রুত বলে শেষ করেই আমি ফোনের সুইচড অফ করে দেই। সুইচড অফ করতাম না। নাদিয়া আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে সুইচড অফ করেছিল। ফোনের সুইচ এর সাথে সাথে বাতির সুইচটাও অফ করে আমরা নিষিদ্ধ একটা জগতে ভেসে গিয়েছিলাম।

সকালে যখন বাসায় ফিরলাম, দেখলাম ইরার চোখে পানি টলমটল করছে। চোখ দু'টো ফুলা ফুলা। মেয়েটা যে সারারাত ঘুমায় নি, সেটা বোঝা যাচ্ছিলো। কি যে নিষ্পাপ লাগছিল মেয়েটাকে! নিষ্পাপ একটা মেয়ের সামনে সদ্য পাপ করে আসা একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। ঘৃণায় আর অনুশোচনায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল তখন। এ আমি কি করলাম!

ইরা কোমল গলায় বলল, রাতে কোথায় ছিলে? আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। ইরা আমার হাতটা ওর মাথায় রেখে অশ্রুভেজা চোখে আবারও বলল, প্লিজ বলো রাতে কোথায় ছিলে? তুমি তো বিয়ের পর একটা রাতও আমায় ছাড়া থাকো নি। তবে আজ কেন? ঠিক তখনই ইরার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার কি হলো আমি বুঝলাম না। আমি বলে দিলাম, নাদিয়ার কাছে ছিলাম। মেয়েটির অমন চোখের দিকে তাকিয়ে আমি মিথ্যে বলতে পারলাম না কেন জানি। এমন নিষ্পাপ মায়াভরা একটা মুখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যে বলার ক্ষমতা আমার ছিল না।

ইরা একদম স্তব্ধ হয়ে গেল আমার কথা শুনে। তার চোখে আর পানি নেই। একরাশ ঘৃণা এসে ভর করেছে সেখানে। ইরা যেন পাথর হয়ে মূর্তির মত আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর শরীর কাঁপছে। ও তখনই বাসা ছেড়ে চলে যায়। যাওয়ার আগে কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিল, তুমি না বলেছিলে নাদিয়ার সাথে তোমার আর কোনো সম্পর্ক নেই। সে তোমার অতীত। আমি সেই অতীতকে মেনে নিয়েই তো তোমার হাত ধরেছিলাম। কিন্তু তারপরও তুমি এই কাজটা কিভাবে করতে পারলে? আমি তোমাকে ঘৃণা করি, বড্ড বেশি ঘৃণা করি। সেদিন আমি মাথা উঁচু করে ইরার মুখের দিকে তাকাতে পারি নি। তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার মত ভাষা আমার কাছে ছিল না।

ডিভোর্স লেটারের খামটা এই মুহূর্তে আমি হাতে নিয়ে বসে আছি। কিছুক্ষণ আগে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস থেকে একজন এসে দিয়ে গিয়েছে। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না ইরা আমাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে। আজকের পর থেকে ইরার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক থাকবে না, ভাবতেই বুকের ভিতরটা কেমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে বার বার। ইরার ঠোটের নিচের তিলটা আর কখনো আমার দেখা হবে না। যে তিলটা দেখেই আমি ওর প্রেমে পড়েছিলাম। মেয়েটা প্রায়ই গভীর রাতে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে ছাদে নিয়ে যেত, জ্যোৎস্নার আলোয় আমাকে চুমু খেতে নাকি তার অন্যরকম ভালো লাগে। রিকশা নিয়ে ঘুরতে বের হলে ইরা প্রায়ই মজা করে বলতো, এই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবা একটানা। অন্যকোনো দিকে তাকাবা না। আমি বলতাম, কেন? ইরা বলতো, আশেপাশে মেয়ে দিয়ে গিজগিজ করছে তাই। তার সেই পাগলামি গুলো আর দেখা হবে না।

কত ভালোই না বাসতো মেয়েটা আমাকে। আর আমি কি না এতবড় একটা প্রতারণা করতে পারলাম মেয়েটার সাথে? আমরা যাকে অনেক বেশি ভালোবাসি, সে আমাদের ছেড়ে চলে গেলে যতটা না কষ্ট লাগে, তারচেয়ে বেশি কষ্ট লাগে, যে মানুষটা নিজে আমাদের অনেক বেশি ভালোবাসতো, সে চলে গেলে। নিজের জীবনটাকে তখন একদমই মূল্যহীন লাগে। আমার হাতের ডিভোর্স লেটার টা ভিজে যাচ্ছে। আমি কি কাঁদছি? ছেলেদের তো কাঁদতে হয় না। নাকি ছেলেদের কান্না সব সময় নিয়ম মানে না? শেষ বারের মত একটাবার কি ইরার সাথে একটু কথা বলা যাবে? আমি ইরার নাম্বারটা বের করে ডায়াল করলাম। সুইচড অফ।

আমি ডিভোর্স লেটার এর আগে কখনো দেখি নি। খামটা খুলে লেটারটা হাতে নিলাম। এটা কি আসলেই ডিভোর্স লেটার? যতদূর জানি ডিভোর্স লেটার কম্পিউটারে টাইপ করা থাকে। কিন্তু এটা তো হাতে লেখা। ইরার হাতের লেখা। আমি পড়া শুরু করলামঃ

"কি, খুব কষ্ট লাগছে তাই না? এই কষ্টের মাত্রা কি আমার কষ্টের চেয়েও বেশি? জানো, সেদিন আমি সারারাত ঘুমাতে পারি নি। এখন তোমার হাত কাঁপছে তাই না? পরদিন সকালে যখন তোমার মুখ থেকে ওই কথাটা শুনলাম, আমারও সেদিন পুরো শরীর কাঁপছিল। মনে হচ্ছিলো আমার কলিজাটা কেউ টেনে ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে। জানো তো, মেয়েরা সব কিছুর ভাগ দিতে পারলেও নিজের ভালোবাসার ভাগ কাউকে দিতে পারে না। তার কষ্ট হয়। প্রচুর কষ্ট হয়। তার মরে যেতে ইচ্ছে করে। আর তার চেয়েও বেশি কষ্ট হয় নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে কষ্ট পেয়ে ছটফট করতে দেখলে। তোমার নিশ্চয়ই এখন খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? মিস করছো আমাকে খুব তাই না? আমার সাথে একটিবার কথা বলার জন্য ছটফট করছো তাই না? ভাবছো আমি এগুলো কিভাবে জানি? ভালোবাসলে অনেক কিছুই টের পাওয়া যায়।

ভেবে দেখলাম, আজ যদি আমি তোমায় ছেড়ে চলে যাই, তাহলে আর কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে সত্য বলার সৎ সাহস পাবে না। মাঝেমাঝে একটাবার কাউকে সুযোগ দিতে হয়। সুযোগ দিয়ে একটাবার তাকে বিশ্বাস করতে হয়। তাহলে দুইটা জিনিস পাওয়া যায়। এক, সত্যিকারের ভালোবাসাটা ফিরে পাওয়া যায়। দুই, বিশ্বাস টা ভেঙে গেলে ভালোবেসে আজীবনের জন্য তাকে ঋণী করে দেওয়া যায়। এর যেকোনো একটা পেলেই আমার আর কিছু চাওয়ার থাকবে না।

আমি আজ রাতেই চলে আসছি। তুমি রেডী থেকো। আজ আমরা সারারাত এই ঢাকা শহরে রিকশায় ঘুরবো। জীবনটাকে আজ থেকে নতুন উদ্যমে শুরু করবো। যেখানে কারও কোনো অতীত ছিল না। বর্তমান থেকেই সব শুরু। শহরের এই দূষিত বাতাসে দুজন মিলে শুদ্ধ হবো। পারবে কি শুদ্ধ হতে?

চিঠিটা হাতে নিয়ে আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। এই চিঠিটা এখন আর কোনো সাধারণ চিঠি না। এই চিঠিটার অনেক মূল্য। একটা নতুন জীবনের যতটা মূল্য। সত্যিকারের ভালোবাসা গুলো সহজে হারায় না। ফিরে আসতে চায় বার বার। আমি আমার ভালোবাসাটা ফিরে পেয়েছি। একে আর হারাতে দেব না। কক্ষনো না। প্রত্যেকটা পুরুষের ভিতরেই একটা করে পশু বাস করে। কেউ সেটাকে মাটিতে পুঁতে ফেলতে পারে, কারোরটা থেকে যায়। আমার ভিতরের পশুটকে যেভাবেই হোক পুঁতে ফেলতে হবে। আজই। এক্ষুনি। আমি নীল একটা পাঞ্জাবি পরে ইরার জন্য অপেক্ষা করছি। পাঞ্জাবিটা ইরার অনেক প্রিয়।

0 Response to "ডিভোর্স লেটারটা আজকে দিনের মধ্যেই চলে আসার কথা। "

Post a Comment